কেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে? - সিমন রায়

 


আমাদের ছোটবেলায় সকলেরই পড়া থাকবে রবীন্দ্রনাথের সেই অমলিন ছড়া – ‘কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি / বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি’। শুক্রবারের হাটে সে সময় নানাবিধ দৈনন্দিন সামগ্রীর পাশাপাশি স্বমহিমায় বিক্রি হত কুমোরপাড়ার সেই সব হারিয়ে যাওয়া কুমোরদের হাতে তৈরি দৃষ্টিনন্দন মাটির কলসি, মাটির হাঁড়ি, মাটির সরা, কড়াই আরো কত কি! মাটির উনানে কাঠের আগুনে মাটির হাঁড়িতে রান্না করে খাওয়ার স্মৃতি ও স্বাদ দুইই বাঙালি ভুলেছে। কুমোরপাড়ার সেই কুমোরেরাও আজ কোথায় হারিয়ে গেছে, দেখা মেলে না কলসি-হাঁড়ি বোঝাই করা গাড়িরও। শুধু কি মাটির বাসন! মাটির পুতুল তৈরিতেও একসময় বাংলার সুখ্যাতি ছিল ভারতজোড়া।

বাঁকুড়ার ঘোড়া, মাটির তৈরি দলমাদল কামান, জয়নগরের ছাঁচের পুতুল, কৃষ্ণনগরের পোড়ামাটির পুতুল শিল্প সব তো বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের নিদর্শন। পয়সা জমানোর জন্য শহুরে ‘আধুনিক’ সমাজ বাড়িতে কিনে আনে পিগি ব্যাঙ্ক কিংবা দম দেওয়া পুতুলের ‘ডগ হাউস’ যেটায় বাটনে চাপ দেওয়া মাত্র একটা কুকুর এসে দরজা খুলে নিয়ে চলে যাবে আঙুলে ধরে থাকা ২ টাকা বা ১ টাকার কয়েন। কিন্তু কয়েক দশক আগেও এই বাঙালির ঘরে ঘরেই শোভা পেত লাল রঙের মাটির লক্ষ্মী-ভাঁড়। চাকা দেওয়া বেতের ধামায় করে টেনে টেনে বা মাথায় নিয়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে যেত ভাঁড়-বিক্রেতারা। আজ তাদের দেখা পাওয়া যায় কেবল লক্ষ্মীপূজার আগে ভাগে। পুজো-আচ্চা উপলক্ষ্যে বাড়ির সকলের সামনে ভাঁড় ভেঙে পয়সা গোনার স্মৃতি ভিডিও গেম খেলা বঙ্গসন্তান ঠাকুমা-দিদিমাদের মুখে গল্পে গল্পে শোনে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

মৃৎশিল্পের প্রধান উপাদান তো মাটি। যেমন তেমন মাটি হলে চলে না, আঠালো এঁটেল মাটি প্রয়োজন। একটি কাঠের চাকায় নরম মাটির তাল লাগিয়ে হাতের নৈপুণ্যে আর কারিগরি-দক্ষতায় কুমোরেরা নানা আকারে মাটির বাসনপত্র তৈরি করে থাকেন। মাটির পুতুল বানানোর সময় চাকা লাগে না, তা বহু যত্ন আর শ্রম দিয়ে হাতে করেই বানান মৃৎশিল্পীরা। কলকাতার বিখ্যাত কুমোরটুলির শিল্পীরা যে অসাধারণ সব দেবী-প্রতিমা নির্মাণ করেন, তাও কিন্তু এই মৃৎশিল্পের মধ্যে পড়ে। আজও বাংলার গ্রামে-গঞ্জে-মফস্বলে খুঁজে দেখলে পটুয়াপাড়ার অবস্থান চোখে পড়বে। 

এখন কোনও বিশেষ পূজা-পার্বণ উপলক্ষ্যে যেমন কুমোরদের ঘরে ঘরে ব্যস্ততা লেগে যায়, আগেও ঠিক তেমনভাবেই শীতকাল হলেই টেরাকোটার কাজের হিড়িক পড়ে যেত বাংলা জুড়ে। টেরাকোটা হল পোড়ামাটির নকশা করা সুদৃশ্য মৃৎশিল্প। মাটির পুতুলই হোক বা অন্য কিছু সেটির কাঁচা কাঠামোটিকে আগুনে পুড়িয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই করে তোলা হত। বাংলার কৃষ্ণনগর, বিষ্ণুপুর এই টেরাকোটার কাজের জন্য আজও বিখ্যাত। আগে নাকি কৃষ্ণনগরের শিল্পীরা মাটি দিয়ে নানা দেব-দেবীর প্রতিমা বানাতেন। 

কৃষ্ণনগরের জলঙ্গী নদীর ধারে ঘূর্ণি অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল কুমোরপাড়া। মাটির পুতুল নির্মাণে এই অঞ্চলের শিল্পীদের কদর আজও সর্বজনবিদিত। বাঁকুড়ার জো পুতুল, ষষ্ঠী পুতুল যারা বানান, বাংলায় রেল চালু হওয়ার স্মৃতিকে মাথায় রেখে এবং নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার ভাবনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে তারাই একসময় বানিয়েছিলেন ‘রেল-পুতুল’। অদ্ভুত এর সৌন্দর্য, দেখলে মনে হবে এমনভাবে মহিলারা পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন যেন একটা ধাবমান রেল।

কিন্তু এসব ঐতিহ্য আজ অবলুপ্তির পথে। কৃষ্ণনগরে জলঙ্গী নদীর পাড় ভাঙছে, ফলে পুতুল বানানোর উপযুক্ত মাটি পাওয়া যাচ্ছে না। আর তার পাশাপাশি এসে গেছে প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন কিংবা বিভিন্ন ধাতব পদার্থের বিকল্প উপাদান। মাটির থালা-বাসনের বদলে ঘরে ঘরে আজ স্টিলের বাসন, মাটির জিনিসপত্রের কদর যেমন কমেছে, তেমনই এত পরিশ্রমের পরে যথার্থ বিক্রিবাটার অভাবে ধুঁকতে বসেছে বাংলার মৃৎশিল্প। বংশপরম্পরার পেশা ছেড়ে এই প্রজন্মের কুমোর-ঘরের ছেলে-মেয়েরা চলে যাচ্ছে অন্য পেশায়। শৌখিন শহুরে মানুষ এখন কেবলই ঘর সাজানোর জন্য কিনে আনে মাটির ঘোড়া নাহলে কালীঘাটের পট। অদূর ভবিষ্যতে বাংলার এই মৃৎশিল্প কেবলই এক মৃত শিল্পে পরিণত হবে হয়তো!  


লেখক পরিচিতি


নাম: 
সিমন রায়

সিমন রায় (জন্ম - ১৪.১০.১৯৯৬)। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্বর্ণপদক সহ প্রথম বিভাগে প্রথম স্থানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। অনুবাদমূলক নানা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া বিভিন্ন ওয়েবসাইটে কনটেন্ট লেখেন। বাংলা থিয়েটার ও নাট্যসাহিত্য চর্চায় নিযুক্ত। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার কাজে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে নিবন্ধ-সংবাদ এবং কিছু মেডিকেল- প্যারামেডিকেল কোর্সের বই ইত্যাদি অনুবাদ করে থাকেন। প্রচুর বই পড়া আর সাহিত্যচর্চায় অবসর যাপন করে থাকেন। শখ বলতে দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্ট

লেপচা জগৎ - ঘুম পাহাড়ের কোলে কাটিয়ে আসুন কিছুদিন

গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় – কেন এত জনপ্রিয় ছিলেন

বাংলার দারুশিল্প - এক অনালোচিত অবহেলিত শিল্পকর্ম - সোমশ্রী দত্ত