বাংলার গথিক কাহিনীর রূপকার ও তার অবদান - সিমন রায়
রবীন্দ্রনাথের ‘মণিহারা’ পড়েছেন তো? কিংবা ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ? আর ইংরেজিতে বলতে হলে ব্রাম স্ট্রোকারের বিখ্যাত বই ‘কাউন্ট ড্রাকুলা’। ‘মণিহারা’ কিংবা ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ সেই যে বিশালাকায় প্রাসাদের বর্ণনা, ভাঙা জানালা-ঝুলে পড়া বারান্দা নিয়ে ‘মণিহারা’র যে সুপ্রাচীন প্রাসাদ কিংবা ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ যখন মেহের আলী চিৎকার করে বলে ওঠে ‘সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়’ তখন লেখকের বর্ণনা পড়ে যেন এক শিহরণময় অনুভূতি জাগে। ভূত নয়, ভৌতিক পরিবেশ এবং স্পষ্টত সেই পরিবেশের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রাচীনত্ব রয়েছে। সাহিত্যের ভাষায় একেই নাম দেওয়া হয়েছে ‘গথিক কাহিনী’। গথিক কথাটাই জুড়ে রয়েছে বিশাল বিশাল সুপ্রাচীন মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের সঙ্গে। মধ্যযুগের সেই বিশাল বিশাল দূর্গ, গির্জা, বিশাল অট্টালিকার মধ্যে দাসদের উপর সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার, খুন, রক্তপাত, হত্যা, এমনকি সেই সব বিশাল দূর্গের মধ্যেকার শূন্যতা সব মিলিয়ে এক গথিক অনুভব তৈরি করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে তৈরি এই ধরনের গথিক সৌধের গোপন সুড়ঙ্গ, গুপ্ত ঘর, অন্ধকার, রহস্যময়তা এসব মিলিয়েই যখন গল্প-উপন্যাস লেখেন লেখকেরা, সেটিকেই গথিক কাহিনি বলা হয়।
১৭৬৫ সাল। প্রকাশ পেল হোরেস ওয়ালপোলের লেখা ‘ক্যাসেল অফ ওটরান্টো’ নামের একটি উপন্যাস। বইটির প্রচ্ছদে নামের নিচে লেখা ছিল ‘এ গথিক স্টোরি’। তারপর ১৮১৮ সালে বেরোলো মেরি শেলির বিখ্যাত সাড়া জাগানো গল্প ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’। তবে তারও আগে ব্রাম স্ট্রোকারের ‘কাউন্ট ড্রাকুলা’ প্রকাশিত হয়ে গেছে। এসবই বিশ্বসাহিত্যের সেরা গথিক কাহিনি। কিন্তু বাংলায় রবীন্দ্রনাথই এই গথিক কাহিনির প্রথম রূপকার। বেশিরভাগ ভূতের ছবিতে (Horror Film) যেমন কাহিনির পাশাপাশি ভৌতিক পরিবেশকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় আর সেটাই আমাদের মনে আতঙ্ক, ভয় জাগায়, ঠিক সেভাবেই রবীন্দ্রনাথও তাঁর বেশ কিছু গল্পে এই ভৌতিক পরিবেশ রচনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।
‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে কথক যে ভাঙা বিশালাকায় প্রাসাদে থাকতেন, সেখানেই শোনা যেত নুপূরের শব্দ, আর্তনাদ, কখনও নাকে আসতো আতরের গন্ধ এমনকি মাঝে মাঝে তার চোখে পড়ে যেত কোনো এক সুন্দরী রমণীকে। রাত্রে যেন কোনো এক অশরীরী আকর্ষণে সারা বাড়ি ঘুমের ঘোরে ঘুরে বেড়াতেন কথক, একদিন তিনি এক বিরহী নারী প্রেতাত্মার তীব্র অসন্তোষ আর কান্না দেখলেন। অদ্ভুত এই আকর্ষণে তার সারা রাত কাটতো আর সকালে মেহের আলীর চিৎকারে ঘোর কেটে যেত তাঁর – সব ঝুট হ্যায়, তফাত যাও, সব ঝুট হ্যায়। এই অদ্ভুত ঘোর লাগা রহস্যময়তা গথিক অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। আবার রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ গল্পেও দেখা যায় বিপত্নীক দক্ষিণাচরণ যখনই তাঁর নববিবাহিতা দ্বিতীয়া স্ত্রীর সঙ্গে একান্তে সময় কাটান তখনই সারা বাড়ির অদ্ভুত নির্জনতা এবং শূন্যতার মধ্যে ভেসে আসে মৃতা প্রথমা স্ত্রীর কণ্ঠ ‘ও কে, ও কে গো?’ বারবার এই একটিই কথা ঘুরে ফিরে আসে গল্পে এবং দক্ষিণাচরণের ছায়ামূর্তি দেখা, হা-হা করে এক বিরাট ও শিহরণ জাগানো হাসি দিয়ে ঘরময় জাগিয়ে দিয়ে এক অশরীরীর চলে যাওয়া এই ধরনের বর্ণনা রবীন্দ্রনাথের গল্পটিকে ভূত ছাড়াই ভূতের গল্পে পরিণত করেছে।
সাহিত্যের গবেষক ও ছাত্রেরা এই ধরনের গল্পকে যদিও অতি-প্রাকৃত গল্প বলে থাকেন। কোচবিহারের মহারানিকে ভূতের গল্প শোনানোর জন্য লেখা ‘মণিহারা’ গল্পটিও তাই। রবীন্দ্রনাথের পরে সার্থক বাংলায় গথিক কাহিনীর লেখক বলতে হয় সত্যজিৎ রায়কে। সাবেকি আমলের নীলকুঠি, বন-বাংলো কিংবা কোনো দূর্গ বা প্রাসাদ নির্জন শূন্যতার মধ্যে বিশাল বাড়ির ভিতরে গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের বেজে ওঠা, ভাঙা গেটের খুলে যাওয়ার দীর্ঘ শব্দ এ সব মিলিয়েই তাঁর গথিক কাহিনিগুলি তৈরি হয়েছে। অনাথবাবুর ভয়, বাদুড় বিভীষিকা, গগন চৌধুরীর স্টুডিও, ব্রাউন সাহেবের বাড়ি ইত্যাদি তাঁর লেখা শ্রেষ্ঠ গথিক গল্প। ফলে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও সত্যজিৎ রায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়কেও বাংলার গথিক কাহিনির রূপকার বলা চলে।
নাম: সিমন রায়
সিমন রায় (জন্ম - ১৪.১০.১৯৯৬)। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্বর্ণপদক সহ প্রথম বিভাগে প্রথম স্থানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। অনুবাদমূলক নানা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া বিভিন্ন ওয়েবসাইটে কনটেন্ট লেখেন। বাংলা থিয়েটার ও নাট্যসাহিত্য চর্চায় নিযুক্ত। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার কাজে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে নিবন্ধ-সংবাদ এবং কিছু মেডিকেল- প্যারামেডিকেল কোর্সের বই ইত্যাদি অনুবাদ করে থাকেন। প্রচুর বই পড়া আর সাহিত্যচর্চায় অবসর যাপন করে থাকেন। শখ বলতে দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ।
মন্তব্যসমূহ