কলকাতার তিন বিখ্যাত বাজারের গল্প - সিমন রায়
সক্কাল সক্কাল বাজারে গিয়ে মাছওয়ালার সঙ্গে দর কষাকষি করে মাছ না কিনলে বাঙালির চলে না, আবার হরেক রকম সবজির মধ্যে হাত দিয়ে দেখে-শুনে একেবারে টাটকা জিনিসটা ঘরে তোলা চাই তার। কলকাতায় বাজারের অভাব নেই, একেক বাজারের একেক বৈশিষ্ট্য। বিশ্বায়নের যুগে কলকাতার সবকটা বাজারের চেহারাই এখন প্রায় একরকম, কিন্তু তবু ইতিহাস মোছে না। বিভিন্ন বাজারকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা কিংবদন্তী, নানা জনশ্রুতি। এইরকমই কলকাতার তিন বিখ্যাত বাজারের গল্প জেনে নেওয়া যাক।
নিউ মার্কেট
কলকাতার একেবারে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত নিউ মার্কেটকে কলকাতার মধ্যে সবথেকে পুরনো বাজার বলে মনে করা হয়। বর্তমানে এসপ্ল্যানেড চত্বরে গেলে কলকাতা কর্পোরেশন বিল্ডিং-এর পিছনদিকেই রয়েছে এই বিশাল বাজার। সাইনবোর্ডে কোথাও কোথাও লেখা দেখা যায় ‘হগ মার্কেট’। এ নিয়েও একটু তালগোল পাকিয়ে যায় মানুষের মনে। এই বাজারের আসল নাম কোনটা – হগ মার্কেট নাকি নিউ মার্কেট? ইতিহাসে ফিরে যেতেই হবে এর উত্তর খুঁজতে গেলে।
কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান স্যার স্টুয়ার্ট হগের উৎসাহে এবং উদ্যোগেই গড়ে ওঠা এই বিশাল বাজার গড়ে ওঠে। ১৮৭৪ সালের ১ জানুয়ারি এই বাজার শুরু হয় আর ১৯০৩ সালে এসে এর নাম দেওয়া হয় স্যার স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট। অনেক পরে কীভাবে যে মুখে মুখে এই বাজারের নাম হগ মার্কেট থেকে নিউ মার্কেট হয়ে গেছে তার ইতিহাস আজও অজানা। ১৯৩০ সাল নাগাদ হার্ভাসফিল্ড থেকে এর বিশালাকায় ঘড়ি এনে বসানো হয় এই মার্কেটের ওয়াচ-টাওয়ারে। এখনও এই রকম বড় ঘড়ি কেবলমাত্র রয়েছে ইংল্যান্ডে আর এই খোদ কলকাতার নিউ মার্কেটে। পৃথিবীর সময় থেমে থাকেনি ঠিকই, কিন্তু সেই ঘড়ির সময় আজও থমকে আছে অযত্নে-অবহেলায়।
যদুবাবুর বাজার
এবারে পায়ে পায়ে দক্ষিণ কলকাতার দিকে গেলে প্রথমেই মনে পড়বে যদুবাবুর বাজারের কথা। এই বাজারের নাম নিয়েই রয়েছে অনেক বিতর্ক – জগুবাবুর বাজার নাকি যদুবাবুর বাজার তা নিয়ে আজও দ্বন্দ্ব মেটেনি। ভবানীপুর অঞ্চলে যোগেশ্বর লাহা নামে এক বাঙালিই প্রথম এই বাজার স্থাপন করেছিলেন বলে জানা যায়। পরে রানি রাসমণি এই অঞ্চল কিনে নিয়ে তা তাঁর নাতি যদুনাথ চৌধুরীকে উপহার দেন। সেই থেকে যদুনাথ চৌধুরীর বাজার মুখে মুখে অপভ্রংশে এসে যদুবাবুর বাজার হয়ে গেছে।
রাসমণির কন্যা কুমারী দাসী ও তাঁর স্বামী প্যারীমোহন চৌধুরীর পুত্র ছিলেন এই যদুনাথ। এই বাজারের আশেপাশে সেই সময় গড়ে উঠেছিল কাঁসারীপাড়া, তেলিপাড়া, শাঁখারিপাড়া কিংবা পটুয়াপাড়া আর অন্যদিকে ভবানীপুরের এই অঞ্চলের খুব কাছেই ছিল বাবু মাধবের ঘাট, রানি রাসমণির ঘাট। ফলে যোগাযোগ ও যাতায়াতের সুবিধের জন্য এই বাজার অত্যন্ত বিখ্যাত হয়ে ওঠে। টাটকা মাছ-মাংস থেকে শুরু করে তুলনায় সস্তা দামে টাটকা শাক-সব্জির খোঁজে আজও দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দাদের ভরসা এই যদুবাবুর বাজার।
কালীঘাট মার্কেট
দক্ষিণ কলকাতাতেই আরেকটি বিখ্যাত বাজার কালীঘাট মার্কেট। এই অঞ্চলটি আদপেই কলকাতার এক বহু পুরনো অঞ্চল। লেক মার্কেটের বর্ধিতাংশ হিসেবে কালীঘাটের মন্দিরের চারপাশেই এই বাজার গড়ে ওঠে সেই উনিশ শতকে। কালীমন্দিরের সংলগ্ন হওয়ার দরুণ, মন্দিরের দর্শনার্থীরা নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এখান থেকেই কেনাকাটা করে থাকেন। অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি এই কালীঘাট মার্কেটের বিশেষত্ব লুকিয়ে আছে এখানকার দশকর্মা ভাণ্ডারগুলির মধ্যে। সত্যি সত্যিই দশ দশ রকমের জিনিসপত্র এই সব দোকানগুলিতেই পাওয়া যায়। হিন্দু আচার-সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ধরনের জপের মালা, ধূপ, পূজার তৈজসপত্র, নামাবলী আরও কত কি যে এখানে পাওয়া যায় তার ইয়ত্তা নেই। মন্দিরের পূজায় ফুল তো লাগেই, ফলে এই চত্বরেই গড়ে উঠেছে একটি ফুলের বাজার।
এভাবেই কলকাতার নানা অঞ্চলের বাজারের একেবারে নিজস্ব কিছু কাহিনি আছে, ইতিহাস আছে। কলকাতার বুকে কান পাতলে সেই সব কাহিনি আজও কেউ যেন বলে চলে।
নাম: সিমন রায়
সিমন রায় (জন্ম - ১৪.১০.১৯৯৬)। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্বর্ণপদক সহ প্রথম বিভাগে প্রথম স্থানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। অনুবাদমূলক নানা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া বিভিন্ন ওয়েবসাইটে কনটেন্ট লেখেন। বাংলা থিয়েটার ও নাট্যসাহিত্য চর্চায় নিযুক্ত। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার কাজে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে নিবন্ধ-সংবাদ এবং কিছু মেডিকেল- প্যারামেডিকেল কোর্সের বই ইত্যাদি অনুবাদ করে থাকেন। প্রচুর বই পড়া আর সাহিত্যচর্চায় অবসর যাপন করে থাকেন। শখ বলতে দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ।
মন্তব্যসমূহ