বাংলার দারুশিল্প - এক অনালোচিত অবহেলিত শিল্পকর্ম - সোমশ্রী দত্ত
Image Source: mashindia |
মানবসভ্যতার আদিলগ্ন থেকে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরনের মধ্যে কাঠ বা দারু একটি অন্যতম উপাদান। সেই প্রস্তরযুগ থেকে পশু শিকার করা ও আত্মরক্ষার প্রয়োজনে মানুষ কাঠের দণ্ডের ব্যবহার শুরু করেছিল। কাঠ প্রাণহীন বা জড় পদার্থ হলেও মানুষ কাঠের উপর বিভিন্ন নকশা, খোদাই ও কারুকার্য করে তা রূপদান করে প্রাণবন্ত করে তোলে। কাঠের গায়ে খোদিত নানান রকমের নকশাই দারুশিল্প নামে পরিচিত।
কাঠ
যেমন খুবই সহজলভ্য তেমনি কাঠের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত আসবাবপত্র,
খাট-পালঙ্ক, দরজা, জানলা, চেয়ার, টেবিল সমস্ত কিছুতেই দারুশিল্পের ব্যবহার দেখতে পাওয়া
যায়। অতীত কালের ভাস্কর্য, মূর্তি নির্মাণে দারুশিল্পের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া গেছে, যা
কৃষ্টি ও সংস্কৃতির এক ঐতিহ্যপূর্ণ দিক।
অতীতকাল থেকে শুরু করে বর্তমানেও বাংলায় দারুশিল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দারুশিল্পীরা কাঠের উপর বিভিন্ন শিল্পকর্ম খোদাই করে তাদের শৈল্পিকতার দিকটিকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। প্রাচীনকালে দারুশিল্পের ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন দেখা গেলেও রাজনৈতিক কারনে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলস্বরূপ বর্তমানে দারুশিল্পের নিদর্শন সেইভাবে আর পাওয়া যায় না। মুন্সিগঞ্জ জেলার রামপাল থেকে দারুশিল্পের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়, যা বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষন করে রাখা হয়েছে।
মালদহ জেলা থেকেও দারুশিল্পের
কারুকার্য করা অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে। পাল ও সেন যুগেও কাঠের ব্যবহার লক্ষ্য করা
গেছে। গ্রীক দূত মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি যে, মৌর্য শাসন কালেও কাঠের
তৈরি ভাস্কর্য ছিল খুবই আকর্ষণীয়। এর থেকে আমরা বুঝতে পারি যে প্রাচীনকালে দারুশিল্প
ছিল অত্যধিক জনপ্রিয় এক শিল্প।
সতেরো
থেকে ঊনিশ শতকের মধ্যে বিদেশী বনিকদের বাংলায় যাতায়াতের ফলস্বরূপ বাংলাদেশের শিল্পকলার
সাথে বিদেশী শিল্পকলার মিশ্রন দারুশিল্পে দেখতে পাওয়া যায়। বাংলার শিল্পকলার সাথে বিদেশী
শিল্পকলার নকশা, অলঙ্করণ সংযোজিত হয়ে গড়ে ওঠে এক মিশ্র শিল্পধারা।
বিদেশী শিল্পকলার সাথে বাংলার শিল্পকলার সংমিশ্রন ঘটিয়ে তৈরি হওয়া নকশা, কারুকার্যগুলি খুবই জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে থাকে। রাজা, বাদশাহ , উচ্চবিত্ত পরিবারের ব্যাক্তিবর্গ, জমিদাররা দারুশিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। দারুশিল্পীদের নিখুঁত সূক্ষ্মতর কাজ, মনোবল, ধৈর্য, কঠিন অধ্যাবসায় এই শিল্পের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লাভ করেছিল।
বাংলাদেশের
দারুশিল্পীরা নিজেদের নকশার সাথে বিদেশী নকশা ও অলঙ্করণকে অনুকরন করে দারুশিল্পের উন্নয়ন
ঘটাতে শুরু করে। শিল্পের উন্নয়নের সাথে সাথে শিল্পীদের আর্থিক অবস্থার ও উন্নয়ন হতে
থাকে। শিল্পীরা তাদের বানানো জিনিসপত্র যে শুধুমাত্র আশেপাশের হাটে- বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করত তাই নয়, তারা তাদের শিল্পকে
দূরদূরান্তের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সেগুলিকে বড়ো বড়ো মেলায় বিক্রি করত। এর জন্য
দারুশিল্পীরা সারা বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে যেতেন।
দারুশিল্পে
খোদিত হয়েছে নানান রকমের মূর্তি, বিভিন্ন প্রতীকী
নকশা যেমন- হাতি, বাঘ, ময়ূর , সাপ, সিংহ, জোড়া পাখি, গাছ ইত্যাদি সেখানে খোদিত করা
হয়েছে। এছাড়াও প্রাধান্য পেয়েছে সেইসময়ের দৈনন্দিন
জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য এবং সামাজিক দিকগুলি।
দেশী
ও বিদেশী ভাবধারার সম্মলিত প্রভাবে দারুশিল্পের ক্রমঅগ্রগতি হতে শুরু হলেও ১৯৪৭ সালে
দেশ বিভাগের পর বাংলাদেশ থেকে অনেক বাংলার শিল্পী ভারতে চলে আসে এবং আর্থ- সামাজিক
অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে, যার ফলস্বরূপ দারুশিল্পের অগ্রগতি অনেকটা ভেঙে পড়তে শুরু
করে ও বিকাশ রুদ্ধ হয়। বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের মতই বাংলার দারুশিল্পও বিলুপ্তির পথে গম্ন করতে থাকে।
বর্তমানে
ঐতিহ্যবাহী দারুশিল্পের বিকাশ ঘটানোর জন্য এবং এই শিল্পের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবার
জন্য বাংলাদেশের গ্রাম- গঞ্জের কিছু মানুষ মূলত মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুরে
বসবাসকারীরা পৈতৃক পেশাকে বেছে নিচ্ছে। কাঠের উপর খোদাই করে যারা কাজ করে তাদের ছুতার
বলে। বর্তমানে তারা মূর্তি, আসাবাবপত্র, পালকি, ঢেঁকি, স্তম্ভ, ভাতের হাতা, পুতুল,
শিশুদের খেলনা, পিঁড়ি, কাঠের সরা, ফুলদানি, গৃহস্থালির নানান সরঞ্জাম, সিন্দুক, প্রসাধনী
বাক্স, একতারা, রথ ইত্যাদি নির্মাণ করছে। পূর্বের ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখবার আপ্রান
পরিশ্রম করে চললেও কিছু প্রতিকূলতার কারনে প্রাচীন কালের মতো বিকশিত হতে তারা পারছেনা।
Image Source: thebengalstory |
অতিমাত্রায় বৃক্ষচ্ছেদনের ফলস্বরূপ কাঠের দুষ্প্রাপ্যতা দেখা দিয়েছে, কাঠের দুষ্প্রাপ্যতার কারনে অধিক হারে কাঠের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক সময়ে দক্ষ শ্রমিকের অভাব দেখা দিচ্ছে ও কারিগরদের মধ্যে আগ্রহের যথেষ্ট অভাব দেখা দিচ্ছে। অতীতে যারা দক্ষতার সাথে শিল্পসত্ত্বার পরিচয় রেখেছিল ও যথেষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিল, বর্তমানে সেই শিল্পীরা সূত্রধর( ছুঁতার ) সম্প্রদায়ে পরিনত হয়েছে। তাদের পারদর্শিতা, অভিজ্ঞতার অবনতি ঘটেছে। কাঠের মূল্য অত্যধিক বৃদ্ধির কারনে ক্রেতার পরিমান ও হ্রাস পেয়েছে। এর ফলস্বরূপ দারুশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। তবুও অতীত কাল থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত দারুশিল্পীরা তাদের যে অসামান্য শৈল্পিকতার পরিচয় দিয়েছে তা অবিস্মরনীয়, যার অবদান আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। এই কারনে দারুশিল্পের ইতিহাস যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও গৌরবময়।
মন্তব্যসমূহ