জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে কমে যেতে পারে উৎপাদনশীল মাছের প্রজাতি - সায়ন দাস


প্রতিনিয়ত আমাদের প্রিয় পৃথিবী উত্তপ্ত থেকে উত্তপ্ততর হযে উঠছে। মূলত মানুষ কর্তৃক পরিচালিত উৎপাদন, পরিবহন, বিপণন, জ্বালানিসহ মাত্রাতিরিক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার, ভূমি ও বন ব্যবহার, ভোগবিলাস ইত্যাদি নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে উৎসারিত গ্যাস এবং বায়ুমণ্ডলে পুঞ্জীভূত গ্রীন হাউজ গ্যাসের সঙ্গে বিক্রিয়ার কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েছে। এবং ভবিষ্যতে তা আরও দ্রুতগতিতে বাড়বে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

এর ফল স্বরূপ অন্টার্টিকার বরফ গলছে আর হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকা বরফ গলা জল সমুদ্রে মিশছে যার ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রের জলস্তর। বিশ্ব জলবায়ুর এই উত্তাপ বৃদ্ধির ফলস্বরূপ ঝর বন্যার পরিমাণ আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখছেন বিজ্ঞানীরা।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল মানুষের জীবনে


“মাছে ভাতে বাঙালি”-এখনো অনেক বৃদ্ধ মানুষকে নষ্টালজিক করে তোলে এক সময়ের এই প্রবাদ। এ প্রজন্মের মানুষরাও শোনে সেই তাদের সেই পুরোনো আবেগ ভরা স্মৃতি । আগে দেশের যে কোনো নদ-নদী, খাল-বিল-জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া গেলেও এখন তা কমে গিয়েছে বহুগুণ। বর্তমানে কৃত্রিমভাবে মাছ উৎপাদন করেই চাহিদা পূরণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মৎস্য সম্পদের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে বলে জেলে, গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন।


এই জলবায়ু পরিবর্তন প্রাণী জগতের ওপর প্রকোপ ও পরিণাম


জলবায়ু পরিবর্তনের আসল কারন গ্রিনহাউস গ্যাস । অন্নুনত এবং উন্নত দেশ - এ ব্যাবহৃত জ্বালানি থেকে নির্গত হয় কার্বন ডাই অক্সাইড যা বায়ুমণ্ডীয় উত্তাপ বৃদ্ধির প্রধান কারন। তাছাড়াও লেড , মিথেন এবং ক্লোরোফ্লুরো কার্বন বায়ুমণ্ডল এর উষ্ণতার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এর ফল স্বরূপ আজ আটলান্টিকের বরফ গলে যাচ্ছে। এর সাথে সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতাও বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। এতে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সমস্ত প্রাণিজগত। মৎস্য প্রজনন ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে দেশীয় প্রজাতির মাছের ক্ষেত্রে এ প্রভাব বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় । বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা এবং সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতাও বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। এসব বিবেচনা করে তা মোকাবিলার জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের আরো গবেষণা করা প্রয়োজন।


জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে কৃতিম মাছ চাষের প্রতিকূলতা


সমুদ্রের জলের পরিমান বৃদ্ধি বা জলস্তর বৃদ্ধির ফলস্বরুপ তীরবর্তী অঞ্চলের পরিষ্কার জলাশয়ে প্রবেশ করছে সমুদ্রের নোনা জল যা মাছ চাষে প্রতিকূলতার সৃষ্টি করছে। পুকুর বা ডোবায় চাষ করা মাছ সমুদ্রের নোনা জলে বাঁচার সম্ভাবনা কম এবং তাদের ডিম ও নোনা জলে ফলন করানো সম্ভব নয়। ফলে দ্রুত এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা শুরু না হলে কৃতিম উপায়ে মাছ চাষে বিরাট বাধার সৃষ্টি হবে বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

সমুদ্র জলের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে শুধু কৃতিম মাছ এর ফলনই না সুন্দরবন এবং সমুদ্র পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অভয়ারণ্য ক্রমশ নিমজ্জিত হচ্ছে বলে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রানিরা তাদের বাসস্থান হারিয়ে ফেলছে। পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে অনেক জীব প্রজাতি মানিয়ে নিতে না চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে এবং সমুদ্র জলের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সুন্দরবনের বহু জলজ প্রানী আজ ক্রমশ বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হচ্ছে। অর্থাৎ সুন্দরবনের জীবপ্রজাতির বৈচিত্র্যে হ্রাসে জলবায়ু পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবন অঞ্চলের সামুদ্রিক খাঁড়ি গুলি লবনতা ও উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন মৎস্য প্রজাতি এই পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারছে না। তাই মৎস্য প্রজাতি গুলির প্রজনন ক্ষমতা কমে গিয়ে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

যদিও প্রতি আর্থিক বর্ষে মাছের কৃত্রিম চাষের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও তা মানুষের সম্পূর্ণ চাহিদা মেটানোর মত হয় নি। উপরন্তু এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিরিক্ত বন্যা ও ঝর দুর্যোগের কারণে মাছ চাষে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। আর্থিক সমস্যার পাশাপাশি মাছের চাষের ব্যয় বৃদ্ধি এবং মাছের দামের বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের সমস্যা আরো বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অনেক প্রজাতির মাছ তাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে ফলে তারা দ্রুত মারা যাচ্ছে।


উপায় এবং বিবেচ্য বিষয়


যদিও এই জলবায়ুর পরিবর্তন এর শুরু আজ থেকে নয় , আজকের মানুষের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা বা খনিজ সম্পদের জ্বালানি এর জন্য নয়, উনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের জন্যও নয় কিন্তু এই জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলাফল যেমনি আমরা বুঝতে পারছি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এর আরো বেশি প্রকোপ সহ্য করবে। তাই আমাদের এটাই করণীয় যে আমরা আজ থেকে এই বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তজনিত কারনসরুপ জ্বালানির পরিণাম কমানো উচিত। নিউক্লিয়ার পাওয়ার এর ব্যাবহার বৃদ্ধি এবং ইলেকট্রিক যানবাহন এর ব্যাবহার বৃদ্ধি করা উচিত। এবং এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত প্রাণীকূল এর প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে তাদের পরিস্তিতি মোকাবিলা এবং আর্থিক সাহায্য দান করে তাদের পরিস্তিতির পরিবর্তনের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় কৃতিম মাছ চাষের আরো পরিকাঠামো ভিত্তিক উন্নয়ন ন্যায্য।

- লিখেছেন সায়ন দাস

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্ট

কেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে? - সিমন রায়

লেপচা জগৎ - ঘুম পাহাড়ের কোলে কাটিয়ে আসুন কিছুদিন

গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় – কেন এত জনপ্রিয় ছিলেন

বাংলার দারুশিল্প - এক অনালোচিত অবহেলিত শিল্পকর্ম - সোমশ্রী দত্ত