দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারঃ ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র কিংবদন্তি স্রষ্টা - সিমন রায়

 

প্রায় প্রতিটি বাঙালিই শৈশবের কোনো না কোনো সময় ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ পড়ে থাকবেন। অনেকে টেলিভিশনে অ্যানিমেশনেও দেখেছেন, সেই ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র স্রষ্টা হিসেবেই বিখ্যাত বাঙালি শিশুসাহিত্যিক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। বাংলার রূপকথার জনক ছিলেন তিনিই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। অথচ এই বইটিই প্রকাশের জন্য প্রথমে কোনো প্রকাশকই রাজি হননি, ফলে নিজেই প্রেস খুলে নিজের বই প্রকাশ করেন দক্ষিণারঞ্জন। তাঁর লেখা সব বইয়ের প্রচ্ছদও আঁকতেন তিনি নিজেই। আজকের বাঙালি শিশু হ্যারি-পটারে মজেছে, দক্ষিণারঞ্জন এবং তাঁর ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ বিস্মৃতপ্রায়।

১৮৭৭ সালের ১৫ এপ্রিল। ঢাকার সাভার উপজেলার অন্তর্গত উলাইল গ্রামে রমদারঞ্জন মিত্র মজুমদার এবং কুসুমময়ী দেবীর কোলে জন্ম হয় দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের। মায়ের মুখে নানাবিধ রূপকথার গল্প শুনেই শৈশব কেটেছে তাঁর। কিন্তু অকালেই মাতৃহারা হন দক্ষিণারঞ্জন। তখন থেকে পিসিমা রাজলক্ষ্মী দেবীর কাছেই বড়ো হয়েছেন তিনি। প্রথমে ঢাকার কিশোরীমোহন হাই স্কুল এবং পরে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। পড়াশোনায় খুব একটা মন ছিল না তাঁর। বাবা ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে চলে এলে তাঁর সঙ্গে দক্ষিণারঞ্জনও সেখানে আসেন এবং বহরমপুরের একটি কলেজে ভর্তি হন। আবাসিক স্কুলে একবার লুকিয়ে লুকিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা পড়তে গিয়ে শাস্তিও পেয়েছিলেন দক্ষিণারঞ্জন। তাঁর বাবা মারা যান ১৯০২ সালে। পিসির নির্দেশে জমিদারির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন দক্ষিণারঞ্জন।

এই জমিদারি পরিদর্শনের কাজেই তাঁকে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হতো। ফলে নানা ধর্ম-বর্ণ-জাতির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা হওয়ার একটা সুযোগ গড়ে ওঠে। বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে শোনা নানা রকমের গল্প তিনি ফোনোগ্রাফের সাহায্যে রেকর্ড করে রাখতেন আর বাড়ি ফিরে সময় করে সেগুলো বারবার শুনতেন। এই লোককথার সংগ্রহ থেকেই গড়ে উঠেছিল বিখ্যাত ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। কিন্তু লেখা তো হয়ে গেল, ছাপবে কে! প্রকাশক জোটে না। 

দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দক্ষিণারঞ্জন পিসিমার থেকে ধার করে সেই টাকা দিয়ে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’  ছাপাবেন বলে নিজেই খুলে বসলেন আস্ত একটা ছাপাখানা। কাকতালীয়ভাবে এই সময়েই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় দীনেশচন্দ্র সেনের এবং তাঁর অনুরোধেই ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন্স প্রকাশনী থেকে ছেপে বেরোলো ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ নির্দ্বিধায় একে সবথেকে বড় স্বদেশি জিনিসের তকমা দিলেন। বাঙালি স্বদেশিয়ানার যুগে এই প্রয়াস ও এই প্রশংসা কম কথা নয়। ১৯০৭ সালে প্রকাশ পেয়েছে এই বই আর তার এক বছরের মধ্যেই হাজার তিনেক কপি নিঃশেষিত। এই বইয়ের রাজা-রানি, কৃষক, দত্যি-দানোর গল্পের মধ্য দিয়ে এক নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন দক্ষিণারঞ্জন।

এরপর একে একে দক্ষিণারঞ্জন লিখে চললেন ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’ (১৯০৯), ‘ঠানদিদির থলে’ (১৯০৯), ‘দাদামশায়ের থলে’ (১৯১৩), ‘চারু ও হারু’ (১৯১২), ‘বাংলার ব্রতকথা’, ‘সরল চণ্ডী’, ‘পুবার কথা’, ‘কিশোরদের মন’ (১৯৩৩), ‘কর্মের মূর্তি’ (১৯৩৩), ‘চিরদিনের রূপকথা’ (১৯৪৭), ‘সবুজ লেখা’ (১৯৩৮), ‘বাংলার সোনার ছেলে’ (১৯৩৭) ইত্যাদি হাজারো বই। বাংলা ভাষায় প্রথম কিশোর উপন্যাস তাঁরই লেখা ‘চারু ও হারু’। সুধা নামে একটি মাসিক পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। এইসব বই লেখার পাশাপাশি নিজে খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতেন তিনি আর সেই কারণে নিজের লেখা বইয়ের প্রচ্ছদও নিজেই আঁকতেন দক্ষিণারঞ্জন। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ বইতেও উডকাটের সাদা-কালো সব অলঙ্করণ তাঁরই হাতে আঁকা যা দেখে মন জুড়িয়ে যায়। শিশু মনের কল্পনার রঙ খেলে বেড়ায় ঐ সাদা-কালো ছবিতে। ছোটদের জন্য লেখালিখির পাশাপাশি ছোটদের খুবই ভালোবাসতেন তিনি।

কলকাতায় দক্ষিণারঞ্জন প্রথমে থাকতেন সূর্য সেন স্ট্রিটের একটা মেসে। সেখানে তাঁর সঙ্গী ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিখ্যাত সমালোচক ও প্রাবন্ধিক নীরদচন্দ্র চৌধুরী। পরে যদিও তিনি পূর্ণদাস রোডে একটি বাড়ি কিনে সেখানেই থাকতে শুরু করেন। ১৯৫৭ সালের ৩০ মার্চ দুর্ভাগ্যজনকভাবে গ্যাস্ট্রিক আলসারের কারণে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের মৃত্যু হয়।



লেখক পরিচিতি


নাম: 
সিমন রায়

সিমন রায় (জন্ম - ১৪.১০.১৯৯৬)। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্বর্ণপদক সহ প্রথম বিভাগে প্রথম স্থানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। অনুবাদমূলক নানা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া বিভিন্ন ওয়েবসাইটে কনটেন্ট লেখেন। বাংলা থিয়েটার ও নাট্যসাহিত্য চর্চায় নিযুক্ত। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার কাজে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে নিবন্ধ-সংবাদ এবং কিছু মেডিকেল- প্যারামেডিকেল কোর্সের বই ইত্যাদি অনুবাদ করে থাকেন। প্রচুর বই পড়া আর সাহিত্যচর্চায় অবসর যাপন করে থাকেন। শখ বলতে দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্ট

কেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে? - সিমন রায়

লেপচা জগৎ - ঘুম পাহাড়ের কোলে কাটিয়ে আসুন কিছুদিন

গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় – কেন এত জনপ্রিয় ছিলেন

বাংলার দারুশিল্প - এক অনালোচিত অবহেলিত শিল্পকর্ম - সোমশ্রী দত্ত