দূর্গাপুজো ও হেরিটেজ ট্যুরিজম - ঐন্দ্রিলা সাউ
Image Source: ich.unesco.org |
“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর”- বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় মহালয়ার এই শ্লোকপাঠ প্রতিটি বাঙালির মনে এক অদ্ভুত ইমোশনের জন্ম দেয়; কারণ- ‘মা আসছেন’। বারোমাসে তেরোপার্বণ পালন করা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দূর্গাপুজো। শরতের পেঁজা তুলো মেঘ, মাঠে-মাঠে কাশফুলের সমাহার, ঝলমলে রোদ, বাঁশের কাঠামোয় মাটির প্রলেপ- সব মিলিয়ে এক অন্যরকম সাজে সেজে ওঠে প্রকৃতি।
কৈলাস থেকে উমার ঘরে ফেরার এই চারদিন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালির কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই উৎসবের জন্য বাঙালির প্রস্তুতি, আবেগ, উন্মাদনা এক অন্য মাত্রা নেয়। শুধু আবেগ নয়, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও এই মহোৎসবের ভূমিকা কম নয়। বহু মানুষের সারাবছরের রুজি-রোজগার অনেকাংশেই এই চারটি দিনের উপ্র নির্ভর করে।
এই বিশেষ পুজোয় ধর্মের মতভেদ ভুলে বাঙালি মেতে ওঠে নিখাদ আনন্দে; যা এই উৎসবকে নির্দিষ্ট জাতিধর্মের গণ্ডি ভেদ করে বৃহত্তর মানবতার উৎসবে পরিণত করেছে। আর এই কারণেই ২০২১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর UNESCO, বাঙালির এই দূর্গাপুজোকে “Intangible Cultural Heritage of Humanity” সম্মানে ভূষিত করেছে। যা নিঃসন্দেহে বাংলার অনন্য সম্মানের মুকুটে এক নতুন পালক যোগ করেছে। এই স্বীকৃতি কলকাতায় খুলে দিয়েছে হেরিটেজ ট্যুরিজমের এক নতুন দিগন্ত, যা সমগ্র বিশ্বের দরবারে বাংলা তথা ভারতকে করে তুলেছে অতুলনীয় লাভবান।
ভ্রমণপ্রেমী মানুষের কাছে বাংলার সুন্দরী তিলোত্তমা চিরকালই আকর্ষণীয় ছিল, তবে এখন কুমোরটুলির প্রতিমা নির্মাণ, অসাধারণ থিম-নির্ভর সব পুজোমণ্ডপ, মায়ের আরাধনা, ঢাকের আওয়াজ, আলোর সাজ, খাওয়া-দাওয়া, প্রতিমা বিসর্জন- এসব কিছু বিদেশি পর্যটকদের কাছে এক নতুন আকর্ষণ। তাই কলকাতা এখন বিদেশি টুরিস্টদের এক হট ডেসটিনেশন।
কলকাতায় দুর্গাপুজোর ইতিহাসঃ-
যে দুর্গাপুজো আজ বাঙালির মেলবন্ধনের প্রধান উৎসব, শুরুতে সেই পুজো কিন্তু মোটেই বারোয়ারী ছিলনা। শিবজায়া উমা তখন আসতেন শুধুমাত্র অভিজাত বাড়ির স্থায়ী ঠাকুর দালানেই। বাংলায় অন্যান্য জায়গায় আরও আগে শুরু হলেও কলকাতায় দুর্গাপুজোর প্রথম সূচনা হয় ১৬১০ খ্রীঃ দক্ষিণ কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বাড়ির ঠাকুর দালানে। এরপর মধ্য কলকাতায় রাণী রাসমণির বাড়ি, উত্তর কলকাতায় শোভাবাজার রাজবাড়ি, হাটখোলার দত্তবাড়ি- এরকম আরও কিছু বনেদি বাড়ির পুজোই ছিল সেসময়ে কলকাতার পুজো। সেযুগে দুর্গাপুজো ছিল আভিজাত্যের প্রদর্শনী; তাই বেশিরভাগ রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়িতেই মায়ের আরাধনা হত। আজকের মত প্যাণ্ডেল হপিং-এর কনসেপ্টটাই তখন আসেনি।
উনিশ শতকের নবজাগরণ এই বনেদিয়ানায় ভাঙন ধরিয়ে গিরিকন্যা পার্বতীকে করে তুলল ঘরের মেয়ে। মাতৃবন্দনার সুরে মিশে গেল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’-এর সুর। ১৯০৯ সালে কিছু অপমানিত যুবকের জেদে সর্বপ্রথম বারোয়ারী দুর্গাপুজোর সূচনা হয় ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট রোডে। সেই থেকেই শুরু হল মহিষাসুরমর্দিনীর আরাধনায় সাধারণ মানুষের মেতে ওঠার জোয়ার। শ্যামপুকুর, সিকদার বাগান, প্রভৃতি জায়গায় শুরু হল বারোয়ারী দুর্গাপুজো। উত্তর কলকাতায় নেবুবাগান হল চতুর্থ বারোয়ারী দুর্গাপুজো যা বর্তমানে বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসব নামে পরিচিত। আস্তে-আস্তে অভিজাত বাড়ির ঠাকুর দালান ছেড়ে মা এসে দাঁড়ালেন পাড়ার পুজো প্যাণ্ডেলে। ধীরে-ধীরে আভিজাত্যের প্রতীক বহনকারী এই পুজো হয়ে উঠল বাঙালির শ্রেষ্ঠ মিলনমেলা।
যতদিন যায় আবারো আসে পরিবর্তন। সাবেকিয়ানার চাদর সরিয়ে দুর্গাপুজো হয়ে ওঠে ‘থিম-নির্ভর’। সমকালীন নানা ঘটনার রূপ ফুটে ওঠে মণ্ডপসজ্জা ও প্রতিমার আদলে। করোনা ভাইরাসে স্তব্ধ পৃথিবী থেকে শুরু করে নেপালের ভূমিকম্প, চিতোরগড়ের দুর্গ থেকে বুর্জ খলিফা- সবই ফুটে ওঠে শিল্পীর দক্ষতায়। শুধু ফুটেই ওঠেনা, বর্তমানে রীতিমত প্রতিযোগিতার আসর বসে বিভিন্ন মণ্ডপসজ্জা, আলোকসজ্জা ও প্রতিমার মধ্যে। তাই শিল্প ঐতিহাসিক দেবদত্ত গুপ্ত যথার্থই বলেছেন- “এই পরিবর্তন আসলে ‘Philosophical change’, মাকে আমি এবছর যেমনভাবে দেখছি পরের বছর ঠিক তেমনভাবেই দেখব তার নিশ্চয়তা নেই”।
বাংলার পর্যটন শিল্পে দুর্গাপুজোর প্রভাব কি?
বাংলার সংস্কৃতি চিরকালই অতিথি পরায়ণ, মিলেমিশে গড়ে ওঠা এক অপূর্ব মিলনপ্রাঙ্গণ। দুর্গাপুজোয় এমনিতেই ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফেরে’ দূর প্রবাস থেকে। যে যেখানেই থাকুক, পুজোর চারটি দিনে জমিয়ে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, প্রতিমা দর্শন- এ প্রতিটি বাঙালির চেনা রুটিন। তাই এমনিতেই এইসময় বাংলা এক মহামিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়। তারপর ইউনেস্কোর দেওয়া ‘হেরিটেজ’ তকমা সেই পালে আরও হাওয়া জুগিয়েছে। শুধুমাত্র কলকাতার দুর্গাপুজো দেখার জন্যই আজকাল দেশ দেশান্তর থেকে বিদেশি পর্যটকরা ভিড় করছে মহানগরীতে।
শুধু পুজোর চারটি দিনই নয়, পুজো শুরুর আগের প্রস্তুতি, খুঁটি পুজো, কুমোরটুলির প্রতিমা নির্মাণ- এসব কভার করতে বেশিরভাগ ভ্রমণপ্রেমী বিদেশিরা পুজোর প্রায় ১ মাস আগে থেকেই ঘাঁটি গাড়ছে কলকাতায়। পুজোর পরেও প্রতিমা নিরঞ্জন, বাঙালিদের নানা আচার অনুষ্ঠান উপভোগ করছে তারা। পুজোর চারদিন রীতিমত বাঙালি বেশে সাজগোজ করে প্যাণ্ডেল হপিং তো তাদের ভ্রমণের একটা অংশ। বেশ কিছু বছর ধরে পুজোর পরে রেড রোডে বিশাল কার্নিভালে একসাথে সব বড় পুজোগুলির ঝলক দেখতেও বিদেশি পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় চোখে পড়ে। স্বভাবতই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বিদেশি পর্যটকদের আগমনে বাংলার পর্যটন শিল্প যে ক্রমশই অগ্রসর হচ্ছে সেটা বলাই বাহুল্য। বিদেশিদের আপ্যায়নে নতুন নতুন প্রচুর হোটেলও গড়ে উঠছে। সাথে সাথে পুজো পরিক্রমার নানা প্যাকেজ তৈরি হচ্ছে। সেই পরিক্রমায় গাইড হিসাবে বহু দক্ষ লোক নিযুক্ত হচ্ছে। চলতি বছর কোভিড অতিমারীর জন্য এই ব্যবসায় কিছুটা মন্দা থাকলেও গতবছর থেকে আবারো ভিড় বাড়ছে পর্যটকদের এবং এবছরও অনেক লোক আসবে এমনটা আশা করা যায়।
দুর্গাপুজো ও তার সাথে জড়িত ট্যুরিজমকে হেরিটজ তকমা দেওয়ার কারণ কি?
বাংলা জন্মলগ্ন থেকেই সংস্কৃতির নানা অমূল্য রত্নে খচিত, দুর্গাপুজো তারই একটি অঙ্গ। বহু মনীষীর হাত ধরে এই পুজো যুগ-যুগান্ত ধরে তার নিজস্ব ঐতিহ্য ও বাঙালির গর্ব বহন করে চলেছে। বাঙালির বারোমাসে তেরোপার্বণ, তাই দুর্গাপুজোর মত এমন বড় বহু উৎসবই আছে। কিন্তু এই পুজোর বিশেষত্ব হল- এতে ধর্ম ও শিল্পকলার অভাবনীয় মেলবন্ধন ঘটে যা প্রকৃত অর্থে ‘হেরিটেজ’। ফলে একে কেন্দ্র করে যে ট্যুরিজমের জন্ম হয়েছে তাও হেরিটেজ। দুর্গাপুজোর আবহে কয়েকটা দিনের জন্য সুন্দরী তিলোত্তমা হয়ে ওঠে যেন এক জীবন্ত আর্ট গ্যালারি। আর মায়ের টানে দেশদেশান্তর থেকে ছুটে আসা মানুষের ভিড়ে খুলে যায় হেরিটেজ ট্যুরিজমের নতুন দিগন্ত।
পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগের উদ্যোগে দুর্গাপুজো ভ্রমণঃ-
বিশ্বের দরবারে মুখ উজ্জ্বল করা হেরিটেজ দুর্গাপুজো দেখতে আসা পর্যটকদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগ থেকে রয়েছে বিশেষ প্যাকেজ। সারারাত সমগ্র কলকাতার বড়-বড় দুর্গাপুজোর মণ্ডপ ঘুরে দেখানো হয়। শুধু পর্যটক নয়, যেকোনো সাধারণ নাগরিকও নিতে পারে এই ভ্রমণের মজা খুবই নামমাত্র খরচে। দুর্গোৎসবের প্রাণময়তা, উন্মাদনা- এসব চোখে দেখার ও উপলব্ধি করার এ এক অভাবনীয় সুযোগ। কোভিড চলাকালীন অনেকরকম সতর্কতা জারি থাকলেও এবছর স্বাভাবিক ছন্দেই মানুষ এই ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই ভ্রমণসূচীর অন্তর্ভুক্ত থাকে বিখ্যাত সব ঐতিহ্যবাহী পুজোমণ্ডপ- কলেজ স্কোয়ার, মহম্মদ আলি পার্ক, কাশীবোস লেন, বাগবাজার সার্বজনীন, বাদামতলা আষাঢ় সংঘ, ৬৬ পল্লী, মুদিয়ালি ক্লাব, শিব মন্দির, একডালিয়া এভারগ্রীন, সিংহী পার্ক, হিন্দুস্থান রোড, রাজডাঙা নব উদয় সংঘ, নাকতলা উদয়ন সংঘ, দেশপ্রিয় পার্ক, সুরুচি সংঘ, ম্যাডক্স স্কোয়ার, আদি বালিগঞ্জ সার্বজনীন, চেতলা অগ্রণী ক্লাব, কুমারটুলি পার্ক, আহিরীটোলা, পাথুরিয়াঘাটা, পাঁচের পল্লী, রবীন্দ্রকানন, তেলেঙ্গাবাগান, মানিকতলা চালতাবাগান, রামমোহন স্মৃতি সংঘ, চোরবাগান প্রভৃতি। যদিও এইসব মণ্ডপ ভ্রমণ একটাই প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত নয়, রুট অনুযায়ী প্যাকেজ। মোটামুটি মাথাপিছু ২২০০/- থেকে শুরু।
সারারাত ঘোরানো হয় এসি বাসে। ২০২৩ সালের ভ্রমণসূচী এখনো প্রকাশিত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগের বুকিং অফিসের ঠিকানা- ৩/২, বিবাদী বাগ (পূর্ব), কলকাতা- ৭০০০০১। ফোন নং- (০৩৩)২২৪৩-৬৪৪০, ১৮০০ ২১২১ ৬৫৫ (টোল ফ্রি নম্বর), ৯০৭৩৩ ৮৬৮০৩, ৯০৭৩৩ ৮৬৮০৪, ৯০৭৩৩ ২৭৩১৫ । অনলাইনেও বুকিং করা যায়। বিস্তারিত জানতে চোখ রাখুন- www.wbtdcl.com
দুর্গাপুজোর রাতে আলোকমালায় চোখধাঁধানো মায়াবী কলকাতায় এই ভ্রমণের মজা যারা নিয়েছে তাদের কাছে সারাজীবন এটি স্মৃতি হয়ে থাকবে।
বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্যগুলির মধ্যে অন্যতম হল দুর্গাপুজো। যুগ-যুগ ধরে সমাজের সকল পরিবর্তনের নিদর্শন বয়ে আসছে এই দুর্গোৎসব। বনেদী সাবেকিয়ানা থেকে আধুনিক থিমের প্রতিযোগিতা- সবকিছুরই সাক্ষী এই উৎসব। আর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে শহর ও শহরতলি জুড়ে শিল্প ও ধর্মের যে মিলন, মানুষের আবেগ, উচ্ছ্বাস, নস্টালজিয়া- এসব কিছুই বাঙালির এই দুর্গোৎসবকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বের দরবারে। ‘হেরিটেজ’ তকমায় ভূষিত করেছে এই আনন্দোৎসবকে। আর এই তকমার জেরে বাংলায় ঘটেছে নবজাগরণ। খুলেছে হেরিটেজ ট্যুরিজমের নতুন দিশা, যা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোকে করে তুলেছে আরও মজবুত।
তবে এই ঐতিহ্যের যথাযথ সংরক্ষণ ও ভবিষ্যতে চর্চার উপযুক্ত পরিকাঠামো গঠনের মাধ্যমেই এই সম্মানের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব। ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’- এর অসাধারণ সমতা বিধানই ভবিষ্যতে আরও বেশি সংখ্যক পর্যটক ও গবেষকদের কলকাতায় এসে এই বিষয়ে কাজ করার উৎসাহ জোগাবে।
মন্তব্যসমূহ