কৃষ্ণনগরের দেব-দেবীর মূর্তি, বাংলার মৃৎশিল্পের অন্যতম নিদর্শন - ঐন্দ্রিলা সাউ

 

Image Source: Amazon

“ও আমার দেশের মাটি, তোমার প’রে ঠেকাই মাথা”- রবীন্দ্রনাথের এই রচনার বহু পূর্ব থেকেই মানুষ তাদের মাথা ঠেকিয়ে আসছে মাটির প’রে, কারণ তাদের উপাস্য দেব-দেবীর মুর্তি যে মাটিরই নির্মিত। আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গে দেব-দেবীর মূর্তি বললেই সবার আগে যে জায়গার নামটা মনে পড়ে সেটা হল কৃষ্ণনগর। বাংলার অন্যতম প্রাচীনতম কুটিরশিল্প হল মৃৎশিল্প, আর কৃষ্ণনগর হল সেই শিল্পের পীঠস্থান। মৃৎশিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় মাটির তালে কিভাবে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়, তা এখানে না এলে বোঝা যাবেনা। 

শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, সমগ্র ভারত তথা বিশ্বের দরবারেও পৌঁছে গেছে কৃষ্ণনগরের এই সুনাম। দেবী দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কালী, শিব-পার্বতী, গণেশ, রাধাকৃষ্ণ- এইসব মৃণ্ময়ী মূর্তি চিন্ময়ী হয়ে ওঠে এখানকার মৃৎশিল্পীদের হাতের যাদুতে, তাদের দক্ষতায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় ঈশ্বরের। অসাধারণ কারুকার্য, রঙ, বানানোর পদ্ধতি- এসবের জন্য কৃষ্ণনগরের মাটির প্রতিমা বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীতে সমাদৃত।

কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের ইতিহাসঃ-

আজ থেকে প্রায় ২০০-২৫০ বছর পূর্বে বঙ্গে মৃৎশিল্পের পীঠস্থান রূপে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের ছোট্ট জনপদ ঘূর্ণি-এর। সেস্ময় ছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকাল। শোনা যায়, তাঁর আমলে অধুনা বাংলাদেশের নাটোর থেকে আসা প্রায় ৩০০ কুম্ভকারদের নিয়ে কৃষ্ণনগরের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে জলঙ্গী নদীর তীরে অবস্থিত এই ছোট্ট জনপদেই গড়ে ওঠে মৃৎশিল্পীদের উপনিবেশ। পরবর্তীকালে ষষ্ঠীতলা, কুমোরপাড়া, নতুনবাজার ও রাজবাড়ির আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েন তাঁরা। 

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন বিদ্যোসাহী ও সংস্কৃতিবান মানুষ। তিনি ও তাঁর বংশের উত্তরপুরুষদের পৃষ্ঠপোষকতায় বারোমাসে তেরো পার্বণের ঐতিহ্যে লেগে থাকত নানা পুজো, আর প্রতিমা নির্মাণের ডাক পড়ত এই মৃৎশিল্পীদের। বিশেষ করে দুর্গাপ্রতিমা ও জগদ্ধাত্রীর মুর্তিতে সেইসময়কার রাজবংশের আভিজাত্য ও মৌলিকতা লক্ষ্য করা যেত কুম্ভকারদের হাতের কাজে। তবে বর্তমানে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প দেব-দেবীর প্রতিমাতেই শুধু আটকে নেই, তার জগৎজোড়া নাম হয়েছে মাটির পুতুল তৈরিতেও। জনৈক প্রফুল্ল সরকার ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ‘কৃষ্ণনগর রাজপরিবার’ নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন- “কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলের আরম্ভ হইয়াছিল কৃষ্ণনগরের রাজার জন্য ‘নরনারীকুঞ্জর’ গঠন হইতে। নয়টি নারী পুতুলের সমষ্টিতে গড়া হইয়াছিল এই অদ্ভুত পুতুল। বিখ্যাত মৃৎশিল্পী যদুনাথ পালের পূর্বপুরুষ গোপাল পাল ইহার স্রষ্টা।“

মাটির প্রতিমা বা পুতুল তৈরির উপকরণ ও বৈশিষ্ট্যঃ-

কৃষ্ণনগরের মাটির প্রতিমা বা পুতুলের যে খ্যাতি তা মৃৎশিল্পীদের হাতের গুণে হলেও মাটির গুণও কিছু কম নয়। জলঙ্গীর পাড়ের বিশেষ মাটি দিয়েই তৈরি হয় এমনসব অভূতপূর্ব ভাস্কর্য। এই মাটি তৈরিও হয় বিশেষভাবে-

১) প্রথমে নদীর পাড়ের উচ্চমানের বেলে ও দো-আঁশ মাটি এনে তাদের মিশ্রণ তৈরি করা হয় এবং তাতে পরিমাণমত এঁটেল মাটি মেশানো হয়।

২) এই তিনপ্রকার মাটি মেশানোর ফলে সেটি চটচটে হয়ে হাতে লেগে যায়না, সূক্ষ্ম কারুকার্যের জন্য একেবারে উপযোগী হয়ে ওঠে।

৩) জলঙ্গীর পাড়ের মাটি খুব পরিষ্কার হয়, একটুও কাঁকড় থাকেনা। ফলে খুব মিহি হয়, তাই মূর্তি নির্মাণের পর অপূর্ব লাগে।

৪) এছাড়াও মূর্তির প্রকৃতি অনুযায়ী নির্মাণের সময় প্রয়োজনে উইয়ের ঢিবির মাটিও মেশানো হয়।

৫)ছোট-ছোট মুর্তির হাত-পা তৈরিতে মাটির সঙ্গে তুলো মেশানো হয়।

৬) অনেকসময় জলঙ্গীর মাটির সাথে রাজমহল এলাকার মাটি মিশিয়েও উৎকৃষ্ট মানের মূর্তি নির্মাণ করেন মৃৎশিল্পীরা।

এই কারণেই এখানকার মৃৎশিল্পীদের কাজে মৌলিকতার ছাপ সুস্পষ্ট। এমন নিখুঁত কারুকার্য ও সূক্ষ্ম শৈলী অন্য কোথাও পাওয়া যায়না। শুধু ছাঁচের প্রতিমাই নয়, বাস্তব সমাজের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক এমন বহু পুতুল বা মডেলও তৈরি করেন এই অঞ্চলের মৃৎশিল্পীরা। হাতে তৈরি আধুনিক পুতুল গড়ার কৌশলও একমাত্র কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি অঞ্চলেই দেখতে পাওয়া যায়। 

বাংলার মৃৎশিল্পের কিছু নিদর্শনঃ-

কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের দুটি সর্বোৎকৃষ্ট শিল্পকলা হল পোড়ামাটির ‘দূর্গা’ ও ‘গণেশ জননী’। ‘দূর্গা’-তে মা সিংহবাহিনী, দশভূজা ও মহিষাসুরমর্দিনী রূপে বিরাজমান। আর ‘গণেশ জননী’-তে উমার কোলে শিশু গণেশ যেন বাংলার মায়ের কোলে শিশুপুত্রের রূপের মাহাত্ম্যকে সার্থকভাবে তুলে ধরেছে। এই দুই শিল্পকলাই কৃষ্ণনগরের সাবেকি মৃৎশিল্পের প্রতীক। তবে প্রতিমা ছাড়াও, পুতুল নির্মাণও যে কৃষ্ণনগরের একটি আইকন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 

১৮৮৮ সালে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প ও কারিগরদের সম্পর্কে ভারতীয় যাদুঘরের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন- “Krishnagar modellers belong to the Hindu caste of Kumars or Potters, one of the nine artisan classes of Bengal, whose rank stands just beneath the Brahmans and Writers. From time immemorial the occupation of the caste has been to make earthen vessels, and the figurative representations of divine manifestations described in sacred books.” এখান থেকেই এটা স্পষ্ট যে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা শুরুতে দেব-দেবীর মূর্তি বানাতেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে যুগের হাওয়ায় এবং খ্রীষ্টান মিশনারি ও ইংরেজ শিল্পরসিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় মাটির পুতুল বানানোর কৌশল রপ্ত করেন তাঁরা। 

একতারা হাতে বাউল, মাঠে কর্মরত চাষি, ঝুড়িভরা টাটকা শাক-সবজি, ক্রন্দনরত শিশু, মাঠে গোরুর লাঙ্গল দেওয়া- এমন নানারকম মূর্তিতে শিল্পীদের হাতের যাদু দেখতে পাওয়া যায়। শহরভিত্তিক মডেলও বাদ যায়না। পুতুলের কোমরে জড়ানো গামছার ডিজাইন, মুখের রেখা, হাতের আঙুল, পায়ের পেশি এসব স্পষ্ট চিহ্নিত করা যায় ঐসব ছোট-ছোট পুতুলে। প্রতিটি পুতুলের চোখ দেখে মনে হয় যেন জীবন্ত। প্রতিটি ছোট-ছোট কারুকার্যকে হাতের দ্বারা জীবন্ত করে তোলাই ঘূর্ণির পুতুলপট্টির মৃৎশিল্পীদের বিশেষত্ব। তবে ঘূর্ণির মৃৎশিল্পীরা বেশি বিখ্যাত মূর্তির ভাস্কর্যের জন্য। ষষ্ঠীতলা, কুমোরপাড়ার শিল্পীরা পুতুল বেশি বানিয়ে থাকেন। কৃষ্ণনগরের আশেপাশে বসবাসকারী কুমোর সম্প্রদায়ের মানুষরা নকশা করা হাঁড়ি-কলসি বানান, সেগুলোও কিছু কম যায়না।

কিছু বিশিষ্ট মৃৎশিল্পীর পরিচয়ঃ-

কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হল- এই অসাধারণ প্রতিভার জন্য তাদের কোনও সার্টিফিকেট বা প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী নেই, সবটাই বংশানুক্রমিক সৃজনশক্তি। এই আশ্চর্য দক্ষতার জন্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- “সেখানে ক্লাসরুম, টেবিল-চেয়ার, লাইব্রেরি, লেকচার হল কিছুই নেই। অথচ দেখা যায় সেখান থেকে পাকা পাকা কারিগ্র বেরিয়ে আসছে- পুরুষানুক্রমে আজ পর্যন্ত।“

১৮৫১ সালে কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত শিল্পী শ্রীরাম পালের ভাস্কর্যের প্রদর্শনী হয়েছিল লন্ডনে। এছাড়াও মৃৎশিল্পী স্বর্গীয় বীরেন পাল, আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত সুবীর পাল, শংকর সরকার, তড়িৎ পাল, স্বর্গীয় কার্তিকচন্দ্র পাল ও তাঁর বংশধর গৌতম পাল প্রমুখ মৃৎশিল্পী এই কৃষ্ণনগরের মৌলিক ধারাকে বহন করে চলেছেন যুগ-যুগ ধরে।

মৃৎশিল্পের বর্তমান অবস্থাঃ- 

কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প আজ প্রায় ২৫০ বছর ধরে চলে আসছে বংশপরম্পরায় পূর্বপুরুষদের হাত ধরে। আজও প্রায় ৪০০ পরিবার ঘূর্ণি ও আশপাশের অঞ্চলগুলিতে এই মৃৎশিল্পের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। এখনও বিভিন্ন পুজোয় কৃষ্ণনগরের দেব-দেবীর প্রতিমার চাহিদা তুঙ্গে। তবে পুতুল শিল্পে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে, বিশেষত করোনার পর। ঘর সাজানোর উপকরণ বা মূর্তি-ভাস্কর্যের বাজারও আগের চেয়ে কমতির দিকে। এর অনেকগুলি কারণ আছে-

১) জলঙ্গী নদীর পাড় ভেঙ্গে যাচ্ছে ক্রমশঃ। ফলে উৎকৃষ্টমানের মাটি জোগাড় করার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

২) কৃষ্ণনগর তথা ঘূর্ণির ভৌগোলিক অবস্থানও এর জন্য বেশ কিছুটা দায়ী। কলকাতা থেকে প্রায় ১১০ কিমি দূরে অবস্থিত এই জায়গার শিল্পকর্ম মানুষের কাছে সহজে পৌঁছতে পারেনা। 

৩) এছাড়াও কৃষ্ণনগরে কোনও ভাল আর্ট কলেজ নেই। এখানকার মৃৎশিল্পীদের ইচ্ছা থাকলেও দূরত্ব ও অর্থনৈতিক কারণে অনেকেই ভাল প্রতিষ্ঠান থেকে এই বিষয়ে শিক্ষালাভ করতে পারেনা।

৪) বর্তমানে মাটির পুতুলের বদলে অনেক শিল্পীই ফাইবার গ্লাস, স্টোন ডাস্ট, প্লাস্টার অফ প্যারিস-এর মূর্তি নির্মাণের দিকে ঝুঁকছেন। এর ফলেও মৃৎশিল্প কিছুটা মার খাচ্ছে।

৫) সরকারি তরফেও এই কুটিরশিল্পের প্রচার কম, ফলে এর বিপণন কম। অনেকেই কম দামে নকল পুতুল বিক্রি করছেন। ফলে আসল শিল্পীদের হাতের কাজ সঠিক জায়গায় পৌঁছতে পারছেনা। 

তবে বর্তমানে এই অবস্থার উন্নতি হচ্ছে ধীরে-ধীরে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তরফ থেকে ‘বাংলার হস্তশিল্প বাঁচাও কমিটি’-এর মাধ্যমে নদীয়া জেলার প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যেই কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। নানা সরকারি মেলায় স্টলে-স্টলে প্রাধান্য পাচ্ছে মাটির পোড়ামাটির ভাস্কর্য। দেশের বাইরে ইউরোপ ও আমেরিকাতেও এই পুতুল রপ্তানি করা হচ্ছে। আশা করা যায়, আমাদের বাংলার এই দুষ্প্রাপ্য  দক্ষতা ও অসাধারণ শিল্পসত্তা আবারও ফিরে পাবে তার হারানো গরিমা।

মাটির সঙ্গে মৃৎশিল্পীদের সম্পর্ক অনেকটা মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির টানের মত, যা কখনোই বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়। বংশপরম্পরায় প্রায় ২৫০ বছর ধরে এই হাতের যাদু আজও একইভাবে মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছে। কালের পরিবর্তনে শিল্পশৈলীতে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া, ঘটেছে অনেক পরিবর্তন। তবে মাটির সাথে বাংলার মানুষের অমোঘ টান আজও অমলিন রয়ে গেছে।


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্ট

কেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে? - সিমন রায়

লেপচা জগৎ - ঘুম পাহাড়ের কোলে কাটিয়ে আসুন কিছুদিন

গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় – কেন এত জনপ্রিয় ছিলেন

বাংলার দারুশিল্প - এক অনালোচিত অবহেলিত শিল্পকর্ম - সোমশ্রী দত্ত