কাটোয়ার কার্তিক পুজো - সিমন রায়

Lyangta Kartik pujo of Katwa


কলকাতার দুর্গাপুজো, চন্দনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো, বারাসাতের কালীপুজো কিংবা নবদ্বীপ-শান্তিপুর অঞ্চলের রাস, এই একেকটি ব্র্যান্ড হয়ে ওঠা পুজোর পাশে একই সারিতে একই জনপ্রিয়তার নিরিখে বিচার চলে কাটোয়ার কার্তিক পুজোর। শুধু পুজোই নয়, কাটোয়ার কার্তিক পূজার বিশেষ আকর্ষণই হল কার্তিকের লড়াই। সে এক আজব জিনিস। 

এই বঙ্গে খাদ্যরসিক পরচর্চা-পরনিন্দাপ্রিয় বাঙালির ঘরে ঘরে কার্তিক ফেলে নিমন্ত্রণ আদায় করার এক অলিখিত মশকরা সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। সদ্য বিবাহিত দম্পতির বাড়ির সদর দরজার সামনেই ছোট-খাটো কার্তিক ফেলে পাড়ার তরুণ-যুবা সমিতি ‘মজা’ দেখে। আসলে এই সব কিছুর মধ্যে দিয়েই কার্তিকের সঙ্গে প্রজননের একটা অদৃশ্য সম্পর্ককেই ইঙ্গিত করা হয়। 

প্রাচীন বাংলায় যে ঠিক এই কার্তিক মাসেই হত নবান্ন, নতুন ধানের চালের পায়েস পাড়া জুড়ে গন্ধ ছড়াতো। সে আবেশ ভোলার নয়। হেমন্তকালে পূজিত এই কার্তিক আদপেই ছিলেন উর্বরতার প্রতীক, কৃষি সভ্যতার প্রতীক। আর তাই আজও সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেই বাংলায় কার্তিক মাসেই পূজিত হন ক্ষত্র কার্তিকেয়।

চুঁচূড়া, বাঁশবেড়িয়া, কাটোয়া পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এইসব জায়গায় কার্তিক পূজা খুবই বিখ্যাত আর তার মধ্যে সর্বোত্তম কাটোয়ার কার্তিক পূজা। এমনকি বলা হয় নাকি এখানকার কার্তিক পূজার সঙ্গে মৌর্য যুগের ঐতিহাসিক অনুষঙ্গও জুড়ে আছে। সাধারণ মানুষ এখানে মূলত পুত্রসন্তান লাভের কামনায় ন্যাংটো কার্তিকের পূজা করে থাকেন। যদিও সেই কার্তিকের পোশাকি নাম খোকা কার্তিক। কাটোয়ার এই খোকা কার্তিক বা ন্যাংটো কার্তিকের সূচনার ইতিহাস বেশ রোমাঞ্চকর। ইতিহাসে দেখা যায়, গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের বর্ণনায় ‘কটদুপা’ নামে একটি জায়গা রয়েছে যাকে আধুনিক কাটোয়া বলেই ধরে নেওয়া হয়। 

ভাগীরথী নদীর মাধ্যমে সে সময় কাটোয়া থেকে কাঁসা-পিতলের বাসন রপ্তানি হত বিভিন্ন জায়গায় আর অন্যান্য জায়গা থেকে লবণ আর মশলা আমদানি করা হত। লবণের বাণিজ্যের প্রসার ও জনপ্রিয়তার কারণে কাটোয়ার একটি ঘাটের নামই হয়ে যায় লবণগোলা ঘাট। এই বাণিজ্যের সুবাদেই বহু বণিকের আনাগোনা হতে লাগলো কাটোয়ায়। যথারীতি তাদের আমোদ-প্রমোদের জন্যেই এখানে ধীরে ধীরে গণিকাপল্লি গড়ে ওঠে। আর সেকালের বাবুরা একাধিক রক্ষিতা রাখতেন নিজের সঙ্গে। সমাজে গণিকাদের সন্তানধারণের কোনও স্বীকৃতি ছিল না। আর তাই গণিকারা তাদের বাবুদের কাছে সন্তানলাভের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। সেই থেকেই কাটোয়ার গণিকাপল্লিতে শুরু হয় কার্তিক পুজো। 

পুরাণে তো কার্তিক স্বয়ং প্রজননের দেবতা। এই ইতিহাসের সূত্র ধরেই ন্যাংটো কার্তিকের পুজো শুরু হয় কাটোয়ায়। খেলনা, বেলুন, মোয়া, কদমা, লাড্ডু ইত্যাদি এই ন্যাংটো কার্তিক বা খোকা কার্তিকের পূজাতে অবশ্যই দিতে হবে নৈবেদ্য হিসেবে। এ যেন সত্য সত্যই শিশুকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা। সন্তানের অপ্রাপ্তি থেকে এই পুজো – কার্তিককে তাই নিজের সন্তানের মত স্নেহ দেওয়ার জন্য আকুল হয়ে পড়েন ভক্তরা।

এই কার্তিক পুজোর আরেকটি বিশেষত্ব হল কার্তিকের লড়াই। এই ব্যাপারটি বড়োই অভিনব। কলকাতার বাবুদের পায়রা ওড়ানো, মোরগ লড়াই দেখার গল্প বহু বহু যুগ ধরে সমাজে চলে আসছে। এমনকি বিশ্বকর্মা পূজার দিন আকাশে ঘুড়ির লড়াইও চলতো সেই সময়। কিন্তু কার্তিকের লড়াই? ভাবা যায়! এই খোকা কার্তিকের পুজোকে কেন্দ্র করেই মহাজন বাবুদের মধ্যে আড়ম্বর প্রদর্শনের একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। 

পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় দুর্গাপূজার সময় এই জাঁকজমকের প্রতিযোগিতা হত, আর কাটোয়ায় সেটাই রূপ নিল কার্তিক পূজাকে কেন্দ্র করে। আভিজাত্য প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় একেক মহাজন তার ঠাকুরকে একেকভাবে বর্ণাঢ্য রূপসজ্জায় সাজিয়ে তুলতেন, সঙ্গে থাকতো শোভাযাত্রা। মোহনীয় আলোর প্রদর্শনী আর পুরাণের বিভিন্ন কাহিনিকে অবলম্বন করে আঁকা ‘থাক’-এর বাহারে সেজে উঠতো এই শোভাযাত্রা। 

এই কার্তিকের লড়াইয়ের ঐতিহ্য আজও বহমান। কত কত স্থানে কত পৃথক নাম কাটোয়ার কার্তিকের। কোথাও সাহেব কার্তিক কিংবা জামাই কার্তিক, আবার তাঁতিপাড়ার সাত ভাই কার্তিক, কাশীগঞ্জ ক্লাবের বাংরা কার্তিক প্রচুর বৈচিত্র্য। আজও পাড়ার ক্লাবগুলির মধ্যে কার্তিক পুজোর সন্ধ্যেবেলায় জোর কদমে প্রতিযোগিতা চলে শোভাযাত্রা নিয়ে। জমিদারদের দেখনদারির ঐতিহ্যের স্মৃতি এভাবে আজও অটুট।  

Image Source:- bengali.oneindia.com  

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্ট

কেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে? - সিমন রায়

লেপচা জগৎ - ঘুম পাহাড়ের কোলে কাটিয়ে আসুন কিছুদিন

গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় – কেন এত জনপ্রিয় ছিলেন

বাংলার দারুশিল্প - এক অনালোচিত অবহেলিত শিল্পকর্ম - সোমশ্রী দত্ত